• ঢাকা, বাংলাদেশ বৃহস্পতিবার, ১৩ মার্চ ২০২৫, ১১:১২ পূর্বাহ্ন
  • [কনভাটার]

ব্রুনো : এক ঐশ্বরিক আলো

ডেস্ক রিপোর্ট। অনলাইন সংরক্ষণ / ২৬ জন দেখেছে
আপডেট : সোমবার, ১৭ ফেব্রুয়ারী, ২০২৫

১৬৩২ সালটি বিজ্ঞানের ইতিহাসে দ্বিতীয় বড় ঘটনা। প্রথম বড় ঘটনাটি ১৫৪৩ সালের। পোলিশ জ্যোতির্বিজ্ঞানী নিকোলাস কোপার্নিকাস (১৪৭৩-১৫৪৩) মৃত্যুর কিছুদিন আগে সে বছর তার সূর্যকেন্দ্রিক বিশ্বের তত্ত্ব প্রচার করেন। তার প্রায় একশ বছর পর ইতালীয় বিজ্ঞানী গ্যালিলিও গ্যালিলি (১৫৬৪-১৬৪২) ১৬৩২ সালে কোপার্নিকাসের তত্ত্বকে গাণিতিক প্রমাণসহ প্রকাশ করেন তার যুগান্তকারী বই ‘ডায়ালগ কনসার্নিং দ্য টু চিফ ওয়ার্ল্ড সিস্টেম’ বা দুই প্রধান বিশ্বব্যবস্থা সম্পর্কিত সংলাপ। সংক্ষেপে বইটি ‘ডায়ালগ’ নামে পরিচিত।

বইটিতে ৩টি চরিত্র। তাদের মধ্যে চারদিন ধরে চলে সংলাপ। সিম্পলিসিও- তিনি প্রতিনিধিত্ব করেন টলেমি ও অ্যারিস্টটলের। প্রাচীন এই দুই বিজ্ঞানী ও দার্শনিকের তত্ত্ব তুলে ধরেন সিম্পলিসিও। সালভিয়াতি- তার অবস্থান কোপার্নিকাসের পক্ষে। তৃতীয়জন সাগ্রেদো, একজন সাধারণ মানুষ। তিনি মূলত গ্যালিলিওর প্রতিনিধি। উল্লিখিত দুজনের তর্কের একটি সিদ্ধান্ত টানেন সাগ্রেদো। হেগেলিয়ান ডায়ালেকটিস অনুসারে সিম্পলিসিও থিসিস (বাদ), সালভিয়াতি এন্টিথিসিস (বিসম্বাদ) আর সাগ্রেদো সিনথেসিস (সম্বাদ)। বইটিতে গ্যালিলিও বৈজ্ঞানিক তথ্যপ্রমাণ দিয়ে দেখিয়ে দেন, কোপার্নিকাসের মতো অনুযায়ী সূর্যকেন্দ্রিক বিশ্বই সঠিক, ভূ বা পৃথিবীকেন্দ্রিক নয়। আর এখানেই গোল বাঁধে; আঘাত লাগে খ্রিষ্টধর্মের প্রচলতি বিশ্বাসে। ফলাফল! চার্চের নির্দেশে গৃহবন্দি থাকতে হয় গ্যালিলিওকে। সাত বছর পর মুচলেকা দিয়ে ছাড়া পান তিনি।গ্যালিলিওকে যখন রোমে ইনকুইজিশনে হাজির করা হয়, তখন তার বয়স ৬৮ বছর। তিনি ছিলেন অসুস্থ। তাকে নির্যাতনের হুমকি দিয়ে প্রকাশ্যে স্বীকার করতে বাধ্য করা হয়, পৃথিবী সূর্যের চারদিকে ঘোরে বলে তিনি যা বলেছেন তা ভুল। কিংবদন্তি আছে, তাঁর স্বীকারোক্তির পরে, গ্যালিলিও চুপচাপ ফিসফিস করে বলেছিলেন, ‘এবং তবুও, এটি চলে যায়’ (ইপ পুর সি মুভ)।

গ্যালিলিওর ভাগ্য সুপ্রসন্ন ছিল। তিনি তার তত্ত্ব প্রত্যাখ্যান করে প্রাণে বেঁচে যান। কিন্তু তার প্রায় চল্লিশ বছর আগে একই ‘অপরাধে’ জিওদার্নোা ব্রুনোকে (১৫৪৮-১৬০০) মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। হত্যা করা হয় জনসম্মুখে আগুনে পুড়িয়ে।কে এই ব্রুনো : ইউরোপের রেনেসাঁকালে কিছু অতি পণ্ডিত ব্যক্তি ছিলেন, যাদেরকে বলা হতো পলিম্যাথ বা সর্ববিদ্যাবিশারদ। জিওর্দানো ব্রুনো ছিলেন তাদের একজন। প্রথমত, তিনি একজন সন্ন্যাসী। তারপর কবি, দার্শনিক, বিশ্বতত্ত্ববিদ এবং একজন গণিতবিদ। জাদুবিদ্যাও অধ্যয়ন করেছিলেন ব্রুনো। তার অবিশ্বাস্য স্মৃতিশক্তির জন্য গোপন জাদুকরী শক্তি আছে বলে মনে করতেন অনেকে। বাগ্মিতা ও প্রবল স্মৃতিশক্তির কারণে অল্প বয়সেই ইউরোপীয় অভিজাত মহলে তার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে।

মাত্র ৫২ বছরের স্বল্প জীবন ব্রুনোর। জন্ম ১৫৪৮ সালে নোলায়। নেপলস এবং মাউন্ট ভিসুয়িাসের খুব কাছের শহর নোলা। ক্যাম্পানিয়ার সবচেয়ে উর্বর ভূমি এটি। কেউ কেউ শহরটিকে ‘ভাগ্যবান’ বলে ডাকেন। নিজের জন্মস্থান সম্পর্কে ব্রুনোর উক্তি, ‘নোলার সোনালি ক্ষেত্র’। হবেই বা না কেন, এখানেই জন্ম রোমান সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা অক্টাভিয়াস (অগাস্টাস) সিজারের। শহরটিতে রোমান সাম্রাজ্যের অতীত গৌরব তখনও জাজ্বল্যমান। শহরটি নিয়ে ব্রুনোর গর্বের অন্ত ছিল না। যে কারণে তার ‘দ্য ক্যান্ডেলবিয়ারার’ নাটকটির প্রচ্ছদে নাম মুদ্রণে লিখেছেন, ‘ব্রুনো, নোলা থেকে আসা এক অপ্রাতিষ্ঠানিক প্রাতিষ্ঠানিক ওরফে ঝামেলাবাজ’।কিশোর বয়সে ব্রুনো একটি ডোমিনিকান কনভেন্টে ভর্তি হন। পড়াশোনা শেষ করে ১৫৭২ সালে সেখানকার একজন পাদ্রি নিযুক্ত হন। কিন্তু তার সঙ্গীরা দেখতে পেলেন ব্রুনোর কাছে নিষিদ্ধ ‘ধর্মবিরোধী’ বই রয়েছে। বইটি আরও কারও নয়, আরেক ‘ধর্মদ্রোহী’ কোপার্নিকাসের। এরপরেই তাকে কনভেন্ট থেকে বের করে দেওয়া হয়, একই সঙ্গে করা হয় সমাজচ্যুত। তখন থেকেই তার পলাতক জীবনের শুরু। ১৫৭৬ থেকে ১৫৭৮ সালের মধ্যে তিনি তুরিন, ব্রেসিয়া, বার্গামো, ভেনিস, পাদুয়া এবং মিলানসহ নানা জায়গায় যাযাবরের মতো ঘুরেফিরে কাটান। তবে তার একরোখা স্বভাবের জন্য যেখানে যেতেন, সেখানেই সমস্যা তৈরি করতেন। সমসাময়িক অনেক পণ্ডিতের সঙ্গে বিরোধে জড়াতেন।

এসব কারণে তিনি ইতালি ছাড়তে বাধ্য হন। শিক্ষকতার একটি চাকরি বা পৃষ্ঠপোষকতার সন্ধানে ব্রুনো ইউরোপের নানা দেশে ভ্রমণ করেন। কিন্তু স্থানীয় ধর্মীয় বা রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষের সঙ্গে দ্বন্দ্ব-সংঘাতের অভ্যাসের কারণে তার সেসব প্রচেষ্টাও ব্যর্থ হয়। যেমন, জেনেভায় ব্রুনো ধর্মতত্ত্বের অধ্যাপক হিসেবে কাজ শুরু করেছিলেন। কিন্তু জেনেভা অ্যাকাডেমির প্রধানের সমালোচনা করে একটি আস্ত গ্রন্থ লিখে ফেলেন। এ নিয়ে তাকে ক্ষমা চাইতে বলা হলেও সেটি তিনি না মেনে শহর ছেড়ে চলে যান।এতসব সমস্যা থাকার পরেও ফরাসি সম্রাট তৃতীয় হেনরি ব্রুনোর প্রতি সুপ্রসন্ন হন। আমন্ত্রণ জানান তার দরবারে। জেনেভা থেকে ১৫৮১ সালে প্যারিসে পৌঁছান ব্রুনো। এখানে কিছুটা হলেও ব্রুনোর ভাগ্য খোলে। ভালো মাইনে রাজার দরবারে প্রভাষকের চাকরি পান। এখানে থাকাকালে মুখস্থ বিদ্যার ওপর কিছু লেখা প্রকাশ করেন ব্রুনো। যার মধ্যে রয়েছে ‘সার্সের গান’ (১৫৮২) এবং ‘দ্য আর্ট অব মেমোরি’ (১৫৮২)। মুখস্থ করার শিল্প বা বিদ্যার একজন দক্ষ বিশেষজ্ঞ হিসেবে তাঁর খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। ষোড়শ শতকের ইউরোপে স্মৃতিবিদ্যার খুব কদর ছিল।

স্মৃতি থেকে বক্তৃতা দেওয়া এবং হাফেজি বা মুখস্থ বিদ্যা না থাকলে সে সময় পণ্ডিতদের অন্দর মহলে জায়গা হতো না। এ কারণে শিক্ষাবিদরা মুখস্থ শিক্ষার ওপর খুব জোর দিতেন। মূলত এই চর্চাটি প্রাচীন গ্রিক অলঙ্কারশাস্ত্রের সঙ্গে সম্পর্কিত ছিল। ফরাসি দরবারে এই প্রতিভার জন্য কিছু খ্যাতি অর্জন করলেও ব্রুনো ১৫৮৪ সালে লন্ডনে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।ইংল্যান্ডে আসার পর ব্রুনো ইতোমধ্যেই অ্যাকাডেমিক মহলে একজন তারকা। এখানেই লিখেন তখনকার সমাজের অভিজাতদের বিদ্রুপ ও কটাক্ষ করে ‘দ্য ক্যান্ডেলবিয়ারার’ (১৫৮২) স্যাটায়ারটি। না, শুধু নাটক লেখা নয়, ইংল্যান্ডে তিনি এসেছিলেন একটি বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে। এখানে নিরিবিলি বসে ছয়টি প্রবন্ধের একটি সিরিজ লেখায় হাত দেন তিনি, যা মহাবিশ্বের প্রকৃতি সম্পর্কে তার বিতর্কিত ও যুগান্তকারী ধারণাগুলো প্রকাশ পাবে। ১৫৮৪ সালে লিখে ফেলেন ‘অন দ্য ইনফিনিট ইউনিভার্স অ্যান্ড ওয়ার্ল্ডস’ নামক বইটি। বইটিতে ব্রুনো একটি বদ্ধ, সীমাবদ্ধ মহাবিশ্বের প্রতি রেনেসাঁ সমাজের প্রচলিত যে বিশ্বাস ও মত ছিল, তা উল্টে দেন।শুধু তাই নয়, ছয়টি প্রবন্ধের বইটিতে ব্রুনো এমন অনেক বিষয়ের পক্ষে যুক্তি দিয়েছেন, যা সৃষ্টিতত্ত্ব নিয়ে তখনকার খ্রিষ্টধর্মের মতের সম্পূর্ণ বিপরীত। ব্রুনোর যুক্তির মধ্যে ছিল, সূর্য সৌরজগতের কেন্দ্রে অবস্থিত, পৃথিবী তার অক্ষের ওপর ঘোরে এবং মহাবিশ্ব নিজেই অসীম। তার এই যুক্তি আজকের সমাজ সত্য বলে মেনে নিলেও তখনকার সমাজে ছিল ভয়ংকর অপরাধ, ধর্মদ্রোহিতা।

➡️ব্রুনো আরও যুক্তি দেন,

যদি মহাবিশ্ব চিরকাল স্থান ও সময়ে বিস্তৃত থাকে, তাহলে অসীম গ্রহ ও নক্ষত্রের মধ্যে ঈশ্বরের রাজ্য ঠিক কোথায় অবস্থিত? ‘ঈশ্বর তার ঐশ্বরিক উপস্থিতি দিয়ে পৃথিবী এবং নক্ষত্রকে ঘিরে রেখেছেন’- প্রচলিত খ্রিষ্টধর্মের এই মতকে অস্বীকার করলেন ব্রুনো। তিনি মহাবিশ্বকে দেখেছেন প্যানথিজম বা সর্বশ্বেরবাদ হিসেবে। অর্থাৎ, ঈশ্বর এক স্থানে বসে পুরোটা জগৎ নিয়ন্ত্রণ করছেন, বিষয়টি আসলে তেমন নয়। ঈশ্বর সর্বত্র বিরাজমান, মহাবিশ্বের প্রতিটি অংশের মধ্যে প্রবাহিত। সর্বেশ্বরবাদ ছিল ব্রুনোর অসীম মহাবিশ্বের একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য।ব্রুনোর দাবি অনুযায়ী, যদি মহাবিশ্ব অসীম সৌরজগতে পরিপূর্ণ থাকে, তাহলে পৃথিবীর এত বিশেষত্ব কী। এছাড়া বাইবেলে অন্য গ্রহের কথা উল্লেখ নেই কেন? ঈশ্বর কি আসলেই অসীম সংখ্যক গ্রহ সৃষ্টি করেছিলেন? যদি তাই হয়, তাহলে কেন এটি ধর্মগ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি?

পোলিশ জ্যোতির্বিদ নিকোলাস কোপার্নিকাস ব্রুনোর অনেক আগেই যুক্তি দিয়েছিলেন যে, বিশ্ব সূর্যকেন্দ্রিক। কিন্তু কোপার্নিকাসও এতদূর যাননি যে, আমাদের মতোই অসীম ‘পৃথিবী’ এবং অসীম ‘সূর্য’ রয়েছে। ব্রুনোই একমাত্র রেনেসাঁ ব্যক্তিত্ব, যিনি অসীম পৃথিবী ও অসীম সূর্যের কথা বলেছেন।

তো যা হওয়ার তাই হলো, বিতর্কিত এসব মতামত নিয়ে ইংরেজ পণ্ডিতদের সঙ্গে ব্রুনোর ঝগড়া বেঁধে গেল। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন শিক্ষাবিদ জর্জ অ্যাবট ছিলেন ইংল্যান্ডের নেতৃস্থানীয় পণ্ডিত। অ্যাবট ব্রুনোকে কোপার্নিকাসের এই মত সমর্থন করার জন্য উপহাস করে বললেন, ‘হ্যাঁ, পৃথিবী আসলেই ঘুরছে এবং স্বর্গ স্থির। প্রকৃতপক্ষে এটি তাঁর (ব্রুনো) নিজের মাথাই বরং ঘুরছিল এবং তার মস্তিষ্ক স্থির ছিল না।’ এর অল্পকাল পরে পুরস্কার হিসেবে অ্যাবট ক্যান্টারবেরির আর্চবিশপ হন। অন্যদিকে তার কিছুকাল পরে ব্রুনোকে ভোগ করতে হয় করুণ পরিণতি।

মহাবিশ্ব নিয়ে এসব তত্ত্ব প্রকাশ করেই ক্ষান্ত থাকেননি ব্রুনো। কঠোর সমালোচনা করেছেন প্রাচীন গ্রিক দার্শনিক অ্যারিস্টটলের। তখনকার সমাজে অ্যারিস্টটলের অবস্থান ছিল অনেকটা প্রফেটের মতো। তার সমালোচনা বা তার মতের বিরুদ্ধে যেতে পারত না কেউ। ব্রুনো এই ‘ডগমা’য় আঘাত হানলেন। নানা যুক্তি দিয়ে অ্যারিস্টটলের তত্ত্বকে অসার প্রমাণ করলেন। এতে অ্যারিস্টটল-ভক্তসহ তখনকার পণ্ডিতসমাজ ব্রুনোর ওপর আরও চটলেন।

এসব তর্ক-বিতর্কের মধ্যেই ১৫৮৫ সালের দিকে ইংল্যান্ডের রানি প্রথম এলিজাবেথের দরবারে অনুগ্রহ প্রার্থনা করেন ব্রুনো। সেটি পেতে ব্যর্থ হয়ে এই ‘বিপথগামী’ দার্শনিক ফ্রান্সে চলে আসেন। তখনকার প্যারিসের পরিস্থিতি ছিল বেশ জটিল। ক্যাথলিক এবং প্রোটেস্ট্যান্টদের মধ্যে সহিংস সংঘর্ষের ঘটনায় প্রতিদিনই কারও না কারও প্রাণ ঝরছে। রাজা তৃতীয় হেনরি প্রোটেস্ট্যান্টদের ওপর থেকে নিজের সমর্থন প্রত্যাহার করে নিলে পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। এমন অবস্থায় ব্রুনো ক্যাথলিক চার্চে প্রবেশ করাকে নিরাপদ বোধ করলেন। তার সেই চেষ্টাও ব্যর্থ হয়। চারদিকে ধর্মীয় উন্মাদনা।এসবের মধ্যেই ব্রুনো উন্মুক্ত স্থানে প্রকৃতি ও মহাবিশ্ব সম্পর্কিত তার দর্শন নিয়ে বিতর্ক সভার আয়োজন করলেন। এই বিতর্কে দেখা দিল মিশ্র প্রতিক্রিয়া। অধিবেশন চলাকালেই একজন ব্যক্তি মঞ্চে উঠে ব্রুনোকে খুব বিশ্রী ভাষায় গালিগালাজ করতে থাকলেন এবং তাকে জর্ডানাস ব্রুটাস (জুলিয়াস সিজারের হত্যার পরিকল্পনাকারী) সম্বোধন করলেন। তবে উপস্থিত অনেকে তার পক্ষও নিলেন।

➡️ব্রুনোর ইতালি ফেরা : এক জায়গায় বেশিদিন থাকার লোক নন ব্রুনো। চাইলেও পারতেন না তাঁর চারপাশের মানুষজনকে শত্রু বানিয়ে রাখার কারণে। তাঁর যাযাবর জীবন যেমন অব্যাহত রাখেন, জাদুবিদ্যা এবং গণিতের ওপর নতুন নতুন তত্ত্ব অনুসন্ধানও থামিয়ে দেননি। প্যারিস থেকে ফিরে এলেন জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্টে। সেখানে কিছুকাল অতিবাহিত হওয়ার পর আমন্ত্রণ পেলেন ইতালির ভেনিসের এক সম্ভ্রান্ত ব্যক্তির। তার নাম জিওভান্নি মোসেনিগো। মোসেনিগো ব্রুনোর স্মৃতি সম্পর্কিত বইগুলোর একজন বড় ভক্ত। সেগুলো সম্পর্কে আরও জানতে চেয়েছিলেন তিনি। তাই ব্রুনোকে নিজের গৃহশিক্ষক হিসেবে আমন্ত্রণ জানান। তার আমন্ত্রণে ব্রুনো ১৫৯১ সালে ভেনিসে আসেন। কিন্তু ‘প্রাইভেট মাস্টারি’তে ব্রুনোর খুব একটা মন নেই। তিনি চেষ্টা করছিলেন নিকটবর্তী পাদুয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি জোগারের। এতে ব্রুনোর প্রতি খুব নাখোশ হন মোসেনিগো। প্রতিহিংসা আর জিঘাংসার বশবর্তী হয়ে ভেনিসীয় ইনকুইজিশনে ধর্মদ্রোহীর অভিযোগ এনে ব্রুনোর বিরুদ্ধে মামলা ঠুকে দিলেন। পরের বছর, অর্থাৎ ১৫৯২ সালের ২২ মে গ্রেপ্তার হন ব্রুবিচারের মুখোমুখি : ভেনিসে ব্রুনো বিচারের মুখোমুখি হন। প্রথম দিকটাতে বিচারকাজ সুষ্ঠুভাবেই সম্পন্ন হয়। মোসেনিগো তার অভিযোগের পক্ষে কোনো সুনির্দিষ্ট প্রমাণ দিতে ব্যর্থ হন। আর ব্রুনো মোসেনিগোর সঙ্গে দর্শনের যে কয়েকটি বিষয় নিয়ে আলাপ করেছিলেন, তার জন্য তিনি ক্ষমা প্রার্থনা করেন। তখন স্থানীয় ট্রাইব্যুনালের রায়ের ফলাফল রোমান ইনকুইজিশনে পাঠানোর রীতি ছিল। বর্তমানকালে অধস্তন আদালতের রায় যেমন উচ্চ আদালতে গিয়ে চূড়ান্ত ফয়সালা হয়, বিষয়টি সেরকম।

১৫৯৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে ব্রুনোকে রোমের ট্রাইব্যুনালে বিচারের জন্য হাজির করা হয়। এবার তদন্তকারীরা মহাবিশ্বের প্রকৃতি সম্পর্কিত বিতর্কিত লেখাসহ ব্রুনোর ধর্মীয় বিশ্বাস নিয়ে নতুন করে তদন্ত ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু করেন। তখন রোমের ইনকুইজিশনে একটা রেওয়াজ ছিল, অভিযুক্তদের অতীত কর্মকাণ্ডের জন্য তারা কতটা অনুতপ্ত, তার ওপর ভিত্তি করে তাদের শাস্তি বা মুক্তি দেওয়া হতো। ধর্মবিরোধী লেখা প্রকাশ বা খ্রিষ্টীয় মতবাদের বিরুদ্ধে যুক্তি দেওয়ার জন্য অভিযুক্তকে শাস্তি না দিয়ে অনুশোচনা ও আত্মশুদ্ধির প্রস্তাব দিতেন বিচারকরা।নো।সেটা না মানলে মৃত্যুদণ্ডের মতো কঠিন শাস্তি দেওয়া হতে। একই প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল ব্রুনোকেও। মানে অপরাধ ‘স্বীকার করো, অনুতপ্ত হও এবং তোমার প্রকাশিত বিতর্কিত সমস্ত লেখা ও বইপুস্তক ধ্বংস করে ফেলো; এটাও অঙ্গীকার করো যে, ভবিষ্যতে এগুলো নিয়ে আর কথা বলবে না এবং বিষয়গুলো কাউকে শেখাবে না।’

➡️রায় ও মৃত্যু: আজন্ম বিদ্রোহী ব্রুনো করলেন উল্টো কাজ। ভেনিসের বিচারের সময় তিনি কিছুটা অনুশোচনা দেখালেও রোমের বিচারালয়ে ব্রুনো তার সমগ্র বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গি প্রত্যাহার করতে অস্বীকৃতি জানালেন। তার দর্শন ও মতের পক্ষে দিলেন দীর্ঘ এক জবানবন্দি। রোমের ইনকুইজিশনে ব্রুনোর বিচার চলে সাত বছর।

পরে বিচারক দেখতে পেলেন, এই আসামি অনুতপ্ত তো নয়-ই, বরং একগুঁয়ে, কঠোর ও ধর্মদ্রোহী রয়ে গেছেন। তাই বিচারক তার রায়ে ব্রুনোকে মৃত্যুদণ্ড দিয়ে দিলেন। ১৬০০ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি রায় ঘোষণা করা হয়। ট্রাইব্যুনাল যখন রায় পড়া শেষ করে, ব্রুনো তখন বলেছিলেন, ‘হে বিচারকগণ! এই রায় ঘোষণা করার সময় আমার যতটা না ভয় লাগছে, সম্ভবত আপনারা তার চেয়ে বেশি ভয় পাচ্ছেন।’

ব্রুনোর মৃত্যুদণ্ডের চূড়ান্ত রায় যে বিচারক ঘোষণা করেন, তিনি পোপ অষ্টম ক্লেমেন্ট। রায় ঘোষণার সপ্তাহখানেক পরে ১৬ ফেব্রুয়ারি পোপ অষ্টম ক্লেমেন্ট তাঁর জয়ন্তী উদযাপন করেন। সেদিন ইতালির বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আগত তীর্থযাত্রী এবং ধর্মযাজকরা উপস্থিত হলেন। চারদিকে উৎসব আর সাজসাজ রব। পোপের জন্মদিন ঘিরে আনন্দ উল্লাসের মধ্যেই পরের দিন, অর্থাৎ ১৭ ফেব্রুয়ারি সকালে রোমের ক্যাম্পো দেই ফিওরিতে চিতা তৈরি করা হলো। স্থানটি ছিল জমজমাট একটি ফুলের বাজার। ভোরে পাতলা, শীর্ণ মুখ, শরীরে ভয়াবহ নির্যাতনের চিহ্ন, হাত শিকলে বাঁধা, খালি পায়ে ব্রুনো ধীর পদক্ষেপে হেঁটে যাচ্ছিলেন চিতাকিছুক্ষণ পর সূর্য আরো উজ্জ্বলতা নিয়ে তার বিকিরণ ছড়াচ্ছিল। এরই মধ্যে জ্বলে উঠল চিতার আগুন। আগুনের শিখা লাফিয়ে উঠে সকালের সুন্দর সূর্যের আলোর সঙ্গে মিশে গেল। ব্রুনো তখন আগুনের মাঝখানে দাঁড়িয়ে। তার হাত দুটো ক্রুশবিদ্ধ করে রাখা। কিন্তু মাথা উঁচু, চোখ খোলা রেখে শান্ত, স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। তার এই দৃষ্টি যেন সমাজের মহান বলে পচিরিত অজ্ঞদের প্রতি তিরস্কার আর বিদ্রুপের বাণ। এই সময় এক ধার্মিক সন্ন্যাসী আগুনের মধ্য দিয়ে একটি ক্রুশবিদ্ধ মূর্তি ছুঁড়ে মারলেন, উদ্দেশ্য যাতে ব্রুনোর পাপ স্খলন হয়, পরকালে মুক্তি মেলে। কিন্তু ঘৃণাভরে ব্রুনো সেটি থেকে তার মুখ ফিরিয়ে নিলেন।র দিকে।ব্রুনোই ছিলেন পৃথিবীর প্রথম ব্যক্তি যিনি পুরস্কারের (পার্থিব বা অপার্থিব) আশা না করে সত্যের জন্য মৃত্যুকে বরণ করে নিলেন। পুড়িয়ে মারার আগে ব্রুনোর মুখ পেরেক দিয়ে বন্ধ করে দেওয়া হয়, প্রতীকী অর্থে স্বাধীন মতপ্রকাশকে চিরকালের জন্য রুদ্ধ করে দেওয়া।

রোমের ক্যাম্পো দে ফিওরির যে বাজারে ব্রুনোকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়, সেখানেই আজ তার একটি বিশাল মূর্তি স্পর্ধা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ঈশ্বরকে ব্রুনো বলেছিলেন, ‘প্রকৃতিতে উদ্ভাসিত মানুষের মন’।

➡️তার আরও ভাষ্য— ‘ঐশ্বরিক আলো সর্বদা মানুষের মধ্যে থাকে। এটি ইন্দ্রিয় এবং বোধগম্যতার কাছে নিজেকে উপস্থাপন করে, কিন্তু মানুষ তা অবহেলা করে।’ সেই আলো আর দশটা মানুষের মতো ব্রুনো অবহেলা করেননি। মূঢ়তার সমাজে ব্রুনো নিজেই এক ঐশ্বরিক আলো। যা অন্ধকার ভেদ করে শতসহস্র বছর ধরে ছুটে চলেছে।

তথ্যসূত্র : গ্যালিলিও গ্যালিলি, ডায়ালগ কনসার্নিং দ্য টু চিফ ওয়ার্ল্ড সিস্টেম—টলেমিক অ্যান্ড কোপার্নিকান; ইংরেজি অনুবাদ— স্টিলম্যান ড্রেক। কাউলসন টার্নবুল, দ্য লাইফ অ্যান্ড টিচিং অব জিওদার্নো ব্রুনো। উইকিপিডিয়া। দ্য কালেক্টর ডট কম।


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

তথ্য ভান্ডার

সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি রবি
 
১০১১১২১৩১৪১৫১৬
১৭১৮১৯২০২১২২২৩
২৪২৫২৬২৭২৮