২০১৯ সালে রাজধানীর রমনা থানায় প্রায় ২০০ কোটি টাকার রাজস্ব আত্মসাতের অভিযোগে ২১টি মামলা করে ঢাকা কাস্টমস গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর। আইন অনুযায়ী এই মামলা দুর্নীতি দমন কমিশনের তপশিলভুক্ত অপরাধ, যা অন্য কোনো সংস্থার অনুসন্ধান ও তদন্তের এখতিয়ার নেই। বিধিবহির্ভূতভাবে দুই বছর ধরে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) মামলাগুলো তদন্ত চালিয়ে আদালতে অভিযোগপত্র দেয়। যদিও আদালত তা গ্রহণ না করে দুদকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ফের তদন্তের জন্য দুদকে পাঠান।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্ভার হ্যাক করে রিজার্ভ চুরির ঘটনাও দুদকের তপশিলভুক্ত অপরাধ হওয়া সত্ত্বেও সিআইডি পাঁচ বছরের বেশি সময় ধরে এটি তদন্ত করছে এবং এখনো আদালতে অভিযোগপত্র দিতে পারেনি।অন্যদিকে, ইলেকট্রনিক মানি বা ই-মানি তৈরি ও নথিপত্র জালিয়াতির মাধ্যমে ৬৪৫ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে ডাক বিভাগের আটজন কর্মকর্তা ও নগদের সিইওসহ ২৪ জনের বিরুদ্ধে গত ৩ ফেব্রুয়ারি মতিঝিল থানায় মামলা করে বাংলাদেশ ব্যাংক; কিন্তু বিধি অনুসারে থানার এ মামলা গ্রহণের এখতিয়ার নেই। বরং এটি সাধারণ ডায়েরিভুক্ত করে অনধিক দুই কর্মদিবসের মধ্যে দুদকে পাঠানোর কথা। তবে ১৫ দিন পেরিয়ে গেলেও তা পাঠায়নি।
এ বিষয়ে মতিঝিল থানার ওসি বলছেন, এটি জালিয়াতির মামলা। তাই থানার পুলিশ এটা তদন্ত করতে পারে।
তবে দুদক বলছে, ৪৬৭, ৪৬৮ ও ৪৭১ ধারায় জালিয়াতি হলে এটি থানার পুলিশ তদন্ত করতে পারে, কিন্তু পাবলিক সার্ভেন্ট জালিয়াতির বিষয়টি শুধু দুদক তদন্ত করতে পারে।
দুদকের মহাপরিচালক (প্রতিরোধ ও মুখপাত্র) মো. আক্তার হোসেন জানান, দুদকের তপশিলভুক্ত কোনো অপরাধের বিষয়ে থানায় অভিযোগ দায়ের করা হলে সংশ্লিষ্ট থানা তা সাধারণ ডায়েরিভুক্ত করে অনধিক দুই কার্যদিবসের মধ্যে দুদকে পাঠাবে। তদন্তের এখতিয়ার থানার নেই।
তিনি আরও বলেন, এখতিয়ারবহির্ভূত সংস্থার তদন্তে আসামিরা সুবিধা পাবে। কারণ, আসামিপক্ষের আইনজীবী বিষয়টি আদালতের নজরে আনলেই অভিযোগপত্র আদালতে গ্রহণযোগ্য হবে না। এতে সময়ক্ষেপণ হবে এবং অপরাধের আলামত নষ্ট হবে।
দুর্নীতি দমন কমিশনের একজন মহাপরিচালক জানান, অপরাধীদের রক্ষা করতেই বাংলাদেশ ব্যাংক মতিঝিল থানায় নগদের বিরুদ্ধে মামলা করেছে। বিধি অনুযায়ী এটি দুদকে পাঠানোর কথা ছিল। থানার অফিসার ইনচার্জেরও এটি নেওয়ার এখতিয়ার নেই। পুলিশের তদন্ত আদালতে গ্রহণযোগ্য হবে না।
দেশে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দুর্নীতি, অনিয়ম ও সরকারি সম্পত্তি তছরুপের তদন্তের এখতিয়ার কেবল দুর্নীতি দমন কমিশনের। তবে অন্যান্য সংস্থা, বিশেষ করে পুলিশ ও সিআইডি, হরহামেশাই দুদকের এখতিয়ারভুক্ত মামলাগুলোর তদন্ত করছে। এতে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর মধ্যে টানাপড়েন তৈরি হচ্ছে, মামলাগুলো নষ্ট হচ্ছে, আসামিরা সুবিধা পাচ্ছে এবং অযাচিত সময়ক্ষেপণে অপরাধীরা আলামত নষ্টের সুযোগ পাচ্ছে।
এ কারণে ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট এক আদেশ জারি করেন। আদেশে দুদকের তপশিলভুক্ত অপরাধের তদন্তের জন্য সব ম্যাজিস্ট্রেটকে সচেতন থাকার নির্দেশ দেওয়া হয় এবং সব থানার অফিসার ইনচার্জকে সজাগ থাকার পরামর্শ দেওয়া হয়।
গত বছরের ৩১ ডিসেম্বর রিজার্ভ চুরি মামলা তদন্তের দায়িত্ব চেয়ে সিআইডিকে একটি চিঠি পাঠায় দুদক। ২ জানুয়ারি সিআইডি চিঠি গ্রহণ করলেও এখনো কোনো সিদ্ধান্ত দেয়নি। তদন্ত সংক্রান্ত সিআইডির একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা কালবেলাকে বলেন, অপরাধের উদ্দেশ্য অর্থ পাচার করা। এখানে সার্ভার হ্যাক করে রিজার্ভ চুরি করে তা বিদেশে পাচার করা হয়েছে। সেক্ষেত্রে অর্থ পাচার মামলা তদন্তের এখতিয়ার সিআইডির আছে। বরং দুদকের নেই।
তবে দুদকের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলছেন, সরকারি কর্মকর্তা কর্তৃক সরকারি সম্পত্তি চুরি হয় না। বরং এটি আত্মসাত, যা দুদকের তফশিলভুক্ত অপরাধ।
দুই সংস্থার এই মুখোমুখি অবস্থান নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকে একাধিক বৈঠকও হয়েছে। সেখানে এই দুই সংস্থার উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা অংশ নিয়েছেন। তবে মামলাটি কারা তদন্ত করবে এই বিষয়ে এখনো কোনো সুরাহা হয়নি।
সিআইডির প্রধান মতিউর রহমান শেখ জানান, সরকারি কর্মকর্তাদের দুর্নীতির তদন্তের এখতিয়ার দুদকের; কিন্তু রিজার্ভ চুরির মামলায় বিদেশি নাগরিকদের সংশ্লিষ্টতা থাকতে পারে। আমরা নিশ্চিত নই, এখানে শুধু সরকারি কর্মকর্তারাই জড়িত কি না। যদি দেখি শুধু সরকারি কর্মকর্তারা জড়িত, তবে এটি দুদকে হস্তান্তর করা হবে।
অন্যদিকে, দুদক বলছে, দণ্ডবিধির ২১ ধারা, দুর্নীতি প্রতিরোধ আইন ও ব্যাংক কোম্পানি আইন অনুযায়ী বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নরসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা সরকারি কর্মচারী। এটি দুদকের তপশিলভুক্ত অপরাধ। তাই এটি দুদকের কাছে হস্তান্তরের কথা।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকে একাধিক বৈঠক হয়েছে। তবে কারা মামলাটি তদন্ত করবে, তা নিয়ে এখনো সিদ্ধান্ত হয়নি।